মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভাগ্যে গত চার বছরে খুব বড় কোনো পরির্বতন আসেনি। বা ভালোভাবে থাকার জন্য তেমন কোনো সুযোগও তৈরি হয়নি। তাদেরকে পাশ কাটিয়েই দেশটির রাজনীতিতে এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। মিয়ানমারের ক্ষমতায় এসেছে গণতান্ত্রিক সরকার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইলেও ‘দেশহীন’ রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে ঠিকই।
তবে অনেক না পাওয়ার মাঝেও আশার আলো জাগিয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি হওয়া ‘অ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট’। এই প্রথম মিয়ানমার সরকার বহু দিনের রাখাইন ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে সাহায্য চেয়েছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ বিশ্ব সম্প্রদায় যখনই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে চেয়েছে তখনই মিয়ানমার সরকার ভাষ্য ছিল, ‘কোনো বিদেশিদের পক্ষেই রাখাইন রাজ্যের সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।’ অবেশেষ তারা আগের অবস্থান থেকে সরে এসে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠন করেছে।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন ৯ সদস্যের একটি টিমকে কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনের ওপরই কিছুটা হলেও নির্ভর করছে রাখাইন ও রোহিঙ্গা সংকটের ইতি টানার প্রথম পদক্ষেপের।
তবে এ সমস্যার সমাধান অনেকটাই নির্ভর করছে অং সান সু চির ওপর। তিনি কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন সেটাও দেখার বিষয়। এর মধ্যে চলতি সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসিচব বান কি মুন মিয়ানমার সফরে আসছেন। আর আগামী মাসের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে অং সান সু চি নিউ ইর্য়ক যাবেন। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গেও তার বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ সময় হয়তো এ বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে।
শান্তিতে নোবেল জয়ী সু চি কেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ৮ লাখ বা তার কিছু বেশি জনগোষ্ঠীর রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করেননি। এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। এই সমালোচনার জন্যই হয়তো আজকে এই কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে কমিশন গঠন করেই সু চির কাজ শেষ হয়ে যাবে না। তার এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য গঠন করা কমিশন এটাই প্রমাণ করছে যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কিংবা সু চির এ ইস্যুতে এতদিনে টনক নড়েছে। সমস্যা সমাধান করতে তারাও আগ্রহী। এ বিষয়ে অনেক প্রশ্ন আছে তবে এখনই সব কিছুর উত্তর মেলা সম্ভব নয়।
অনেকে মনে করতে পারেন, ৭৮ বছর বয়সী কফি আনানের পক্ষে এ নিয়ে কী করবেন। তবে কফি আনান একাই একশ। আগামী বছর আগস্টের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। আশা করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকারের রক্ষা এবং তাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দেবে এ কমিশন।
তিবে মিয়ানমারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব বিষেয় উত্থাপন করা সু চির জন্য খুব একটা সহজ হবে না। কারণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুধু কট্টরপন্থী বৌদ্ধরাই কেবল বাধ সাধবে না অন্যান্য রাজৈনৈতিক দলও বিরোধিতা করেব। কাজেই কফি আনানের প্রতিবেদন মিয়ানমারে বিতর্কের জন্মও দিতে পারে।
রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ ধর্মালম্বী ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের সমস্যা এতোটাই গভীরে যে রাতারাতি সমাধান সম্ভব হবে না। মিয়ানমারের দাবি, সীমান্ত পার হয়ে রোহিঙ্গা মুসলিমরা প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে প্রবেশ করেছে। এজন্যই তাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে চায় না দেশটির সরকার। তবে বাংলাদেশও রোহিঙ্গাদের নিজেদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না।
২০১২ সালের সহিংসতার পর এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর চার বছর পার হয়ে গেলেও তাদেরকে তাদের ঘর-বাড়িতে ফিরিয়ে আনার কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
রাখাইন রাজ্যের বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন প্রকাশ্যেই রোহিঙ্গাদের বিরোধিতা করে চলেছে। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সাহায্য দিতে যাওয়া আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও জাতিসংঘের বিরোধিতা করেছে তারা। সেখানে কফি আনানকে যে তারা স্বাগত জানাবেনা এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
তবে কমিশন যে সুপারিশই করুক না সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া কিংবা তা বাস্তবায়ন করা বেশি কঠিন হবে। তারপরও রোহিঙ্গাদের জন্য এমন একটি কমিশন গঠন করাটা নতুন কিছু। ছোট পদক্ষেপ হলেও দীর্ঘ দিনের সমস্যা সমাধান একটা পদেক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটাই আশার কথা। সূত্র: বিবিসি।
পাঠকের মতামত